জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের করণীয় - রচনা সম্পর্কে জেনে নিন

 

Image

জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের করণীয় - রচনা 

ভূমিকা

বর্তমান বিশ্বে যতগুলো আলোচিত ও জরুরি সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন হলো অন্যতম একটি সমস্যা। জলবায়ুর পরিবর্তন বলতে গেলে এটি ২১ শতকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে জীববৈচিত্রের ওপর দিন দিন যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে তা আমাদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

বিজ্ঞানীদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন মানব সভ্যতা এবং প্রকৃতির জন্য বড় বিপর্যয়।পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি, ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া, বরফ গলার হার বৃদ্ধি পাওয়া, বন্যা, ক্ষরা কিংবা ঘূর্নিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সবাই যেন এই পরিবর্তনের পরিণাম। বিশ্বজুড়ে এই পরিবর্তন নিয়ে ব্যাপকহারে গবেষণা চলছে।

জলবায়ু কাকে বলে

ভূপৃষ্ঠের কোন স্থানের ২৫ থেকে ৩০ বছরের আবহাওয়ার গড় অবস্থানকে বলা হয় ওই স্থানের জলবায়ু। জলবায়ু মূলত কোন স্থানের দীর্ঘদিনের বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, বায়ু প্রবাহ, রৌদ্রালোক ইত্যাদির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনকে নির্দেশ করে থাকে। জলবায়ু প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়।

জলবায়ুর উপাদান

জলবায়ুর প্রধান উপাদান হল বায়ুর তাপ, বায়ুর চাপ, আদ্রতা, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি। আবহাওয়ার মত জলবায়ু ও নিয়ন্ত্রিত হয় অক্ষাংশ, ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা, সমুদ্র হতে দূরত্ব, বায়ু প্রবাহের দিক, সমুদ্রের স্রোত ইত্যাদি দ্বারা। আবহাওয়ার উপাদান সমূহ ও তাদের নিয়ন্ত্রণকালীন নিয়ম পরিবর্তন সমূহ পরিবর্তন এর সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়া এবং জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে।

জলবায়ুর প্রকারভেদ

আমরা জানি জলবায়ু ছয় ভাগে বিভক্ত। যেমন -

  1. নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু 
  2. আদ্র জলবায়ু 
  3. শুষ্ক জলবায়ু 
  4. সামুদ্রিক জলবায়ু 
  5. চরমভাবাপন্ন জলবায়ু 
  6. সমভাবাপন্ন জলবায়ু 

তবে এলাকাভেদের জলবায়ুর তারতম লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন এলাকা বা প্রাকৃতিক অঞ্চল গুলো কোন নির্দিষ্ট সীমা রাখা দ্বারা পৃথক করা সম্ভব নয়। যেমন বাংলাদেশের জলবায়ু হলো নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু।

জলবায়ুর পরিবর্তন

জলবায়ু আবহাওয়ার মতো প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা আবহাওয়া মন্ডলের উত্তাপ বৃদ্ধি, ঋতু চক্রের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যাওয়া, ঋতু বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন, অতিবৃষ্টি, অনা বৃষ্টি, অসময়ে বন্যা, সামুদ্রিক ঝড়, দাবানল, সমুদ্রের পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে প্রতিনিয়ত জলবায়ু পরিবর্তিত হয় যা সারা বিশ্বের পরিবেশবিদগণ লক্ষ্য করেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ

বর্তমানে সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচিত বিষয় হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল জলবায়ু পরিবর্তন। প্রতিনিয়ত এই জলবায়ুর পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পুরো পৃথিবী আজ ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে আর এই ধ্বংসের প্রধান কারণ হলো মানুষ নিজেই। মানুষ জলবায়ুর স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতির পেছনে বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যা আজ বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।

আমরা জানি, অক্সিজেন আগুন জ্বালাতে সাহায্য করে আর পৃথিবীতে যত আগুন জ্বলবে অক্সিজেনের ব্যবহার ততই বাড়বে এবং অক্সিজেনের ঘাটতি হতে থাকবে কারণ মানুষ অযথা গাছ কেটে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে যার কারণে পৃথিবীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মেরু অঞ্চলের বরফ বলতে শুরু করেছে, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে আর এর কারণ হচ্ছে গ্রীন হাউজ। কারণ গ্রীনহাউসে সিএফসি গ্যাসের অতিমাত্রিক নির্গমন হয় যা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।

এ ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হলো মানবকৃষ্ট কার্যকলাপ। যেমন-

অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ।

বনভূমি উজাড়।

জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার যেমন - কয়লা, পেট্রোল ইত্যাদি।

শিল্প কারখানা ও যানবাহনের দূষণ।

জলবায়ু পরিবর্তন এর প্রভাব

জলবায়ুর পরিবর্তন যে শুধু প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলে তা নয়, এটা মানুষের জীবন এবং জীবিকাতেও প্রভাব ফেলেছে। যেমন-

পানির সংকট

কৃষি ক্ষেত্রে ফসলের ক্ষতি

জলবায়ুর উদ্যাস্ত সংখ্যা বৃদ্ধি

বাংলাদেশের মতো উপকূলীয় দেশগুলোতে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি

বন্যা

খরা

অতিবৃষ্টি

অনাবৃষ্টি

লবণাক্ততা বৃদ্ধি

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি

জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে আর এর প্রধান কারণ হলো মেরু অঞ্চলের পর্বতের জমে থাকা বরফগুলো গলতে শুরু করেছে। জাতিসংঘের আন্তঃসরকার ২০০৭ সালে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেলে এক প্রতিবেদনে বলেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের পানি এত উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে যে, এর ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ১৭ শতাংশ ভূমি পানির তলে ডুবে যাবে এবং আগামী ২৫ বছরের মধ্যে মালদ্বীপ নামক রাষ্ট্রটি পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে যাবে।

ঝড় জলোচ্ছ্বাস

বর্তমান সময়ে ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্চ মাস থেকে জুলাই মাস হল কালবৈশাখী ঝড়ের সময় অথচ এখন আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিগত কয়েক দশক থেকে আইলা, সিডর, নার্গিস, হারিকেন, টাইফুন, টর্নেডো সহ বিভিন্ন ধরনের সুনামি বিশ্ববাসিকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।

বন্যা

বর্তমান সময়ে বন্যা, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য হুমকির সম্মুখীন হয়ে দাঁড়িয়েছে আর এর প্রধান কারণ হলো জলবায়ুর পরিবর্তন। আকস্মিক বন্যা পৃথিবীর জন্য হুমকি স্বরূপ। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সাথে ও উন্নত দেশগুলো আজ এই ভয়াল বন্যার কবলে আবর্তিত হচ্ছে।

অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, দাবানল

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে একদিকে যেমন অসময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টি হচ্ছে আবার অন্যদিকে যখন বৃষ্টির প্রয়োজন তখন দীর্ঘদিন ধরে খরার সৃষ্টি হচ্ছে যা তাপমাত্রাকে অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর এর কারণে সৃষ্টি হচ্ছে দাবানল। বর্তমান সময়ে অর্থাৎ ২০২৫ সালে আমেরিকার কার্লিফোরিয়ার দাবানল সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

মাটির লবণাক্ত তাপ বৃদ্ধি

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অসময়ে সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পানি উপকূলীয় অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি করছে যার কারনে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

আমাদের করণীয়

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের প্রকৃতির যে পরিবর্তন হয়েছে এবং এর ফলে আমরা যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি তার হাত থেকে বাঁচতে হলে অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেমন-

বনভূমি বাড়ানো

জলবায়ের পরিবর্তনের এই কুপ্রভাব থেকে বাঁচতে হলে আমাদের বনভূমির বাড়াতে হবে অর্থাৎ বেশি করে গাছ লাগাতে হবে এবং বনভূমি সংরক্ষণ করতে হবে যা জলবায়ু রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখবে।

পুন ব্যবহার ও রিসাইক্লিনিং।

কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস রয়েছে যেমন কাগজ বোতল প্লাস্টিক ইত্যাদি কোন ব্যবহার করে বর্জ্য কমানো যায়।

জ্বালানি সাশ্রয়ে অভ্যাস।

বৈদ্যতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে ও সচেতন হতে হবে সৌরশক্তি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

পরিবেশবান্ধব যাতায়াত।

গাড়ির পরিবর্তে হাঁটা, বাইসাইকেল কিংবা গণপরিবহন ব্যবহার করা উচিত।

সচেতনতা ও শিক্ষার প্রসার।

ইঞ্জিন চালিত গাড়ির ব্যবহার যথাসম্ভব কমাতে হবে কারণ এর কালো ধোয়া পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

রাস্তার দুইপাশ, বাড়ির চারপাশ, রেল লাইনের দুই পাশে এবং বিদ্যালয়ে সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও গাছ লাগানো বাড়াতে হবে।

স্কুল কলেজ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জলবায়ু সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে।

বাংলাদেশের জলবায়ু

বাংলাদেশের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ। এরপরেও বিশ্বের যেসব দেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি হুমকির সম্মুখীন বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশের তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে সর্বোচ্চ ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত দেখা যেত এবং শীতকালে সর্বনিম্ন ১১ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতো অর্থাৎ বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। 

কিন্তু বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বাংলাদেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে যা ৩৬ ডিগ্রি থেকে বর্তমানে ৩৯ - ৪০ এমন কি ৪১ - ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা ও লক্ষ্য করা যায়। আর এই তাপমাত্রার প্রধান কারণ হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন।

বাংলাদেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন

২০০৯ সালের ৭ই ডিসেম্বর কোপেনহেগেনে শুরু হয় জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলন এবং এখানে ১৯৩ টি দেশ অংশগ্রহণ করে।১৯ ডিসেম্বর একটি অঙ্গীকার নামার মাধ্যমে এই সম্মেলন শেষ হয়। এতে উন্নত দেশ অঙ্গীকার করে যে, তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনে মোকাবেলা করতে ৩০ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেবে।

এছাড়াও বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো যেন জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এজন্য দরিদ্র দেশগুলোকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেওয়ার কথা ও এখানেও প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হওয়ার আশঙ্কায় তারা ১৫ শতাংশ সাহায্য পেতে পারে।

উপসংহার

জলবায়ু পরিবর্তন এমন একটি সমস্যা যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে তাই এখনই আমাদের সচেতন হতে হবে এবং প্রতিটি মানুষকে পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে হবে।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url